বিষাদ

খয়েরি রঙের কার্ডটা টেবিলের উপর পড়ে আছে। রাজিভ এক পলক দেখল কার্ডটা। খামের ভেতর থেকে আমন্ত্রণপত্রটা বের করল। বামপাশের নামটা তার ভীষণ পরিচিত। কিন্তু ডানপাশের নামটা অপরিচিত। কার্ডের টাইটেল: আনিতা-জামানের শুভ বিবাহ।


টাইটেল দেখে রাজিভের ভেতরটা ডুকরে উঠল। আনিতার সাথে ক'দিনের পরিচয়! এই তো, মাত্র সাড়ে চার বছর। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগা। সচরাচর যা হয় আর কি। এরপর প্রেম নিবেদন। তাও একবার নয়, দু'দুবার। দু'বারই রিজেক্টেড।

তারপর রাজিভ আর কোনো চেষ্টা করেনি। আর যাইহোক, ভালোবাসা তো আর জোর করে হয় না। কেন আনিতা রাজিভকে রিজেক্ট করেছিলো তা রাজিভ জানে না । তবে তারা দুজন ভালো বন্ধু হয়ে থাকবে এই আশ্বাস দিয়েছিলো আনিতা। রাজিভ আশাবাদী ছেলে। ভেবেছিলো এই বন্ধুত্ব হয়তো একদিন প্রণয়ে রূপ নিবে।

এমন অনেক রাত গেছে রাজিভ ম্যাসেঞ্জারে আনিতার ম্যাসেজের অপেক্ষা করেছে। এই বুঝি আনিতা তাকে বলছে, "রাজিভ, তোমাকে আমি অনেক অপেক্ষা করিয়েছি। আর পারছি না। তোমার বাহুডোরে আমাকে আগলে ধরো। তোমার ভালোবাসার সুরা দিয়ে আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা মিটাও। আমাকে গ্রহণ করো, একটু প্রশান্তি দাও।" কিন্তু এসবই ছিলো রাজিভের কল্পনা। আনিতা কখনো ম্যাসেজ দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে আনিতা রাজিভকে কখনো অনুভবই করে দেখতে চায়নি।

তবে মাঝেমধ্যে দেখা হত তাদের। কখনো টিএসসি কখনো ফার্মগেট। রাজিভ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, আনিতা ফার্মগেট হোস্টেলে। হুট করেই গতকাল আনিতার বিয়ের কার্ড এসে পৌঁছায় রাজিভের হাতে। তাদের অরেক বন্ধু রাফির মারফতে আনিতা কার্ডটা পাঠায়।

কার্ড হাতে পেয়ে টেবিলের উপর রেখে দেয় রাজিভ। সারাদিন বিভিন্ন ব্যস্ততায় যায়। মাঝরাতে হলে ফেরে। রুমে ঢুকে জামাটা খুলে বসতেই চোখে পড়ে কার্ডটা। হলের অধিকাংশ ছেলেরাই এখন ঘুমে। তাই চারদিক নিস্তব্ধ বলা যায়।

খয়েরি রঙের কার্ডটা হাতে নিল রাজিভ। কার্ডের গায়ে লেখা সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করতে করতে চোখ ছলছল করে উঠল। মনে হলো অন্তরটা কাচের মতো ভেঙ্গে সহস্র টুকরো হয়ে গেছে। রাজিভ কাঁদছে। তবে কোনো শব্দ হচ্ছে না। স্লিপিং প্যারালাইসিস হলে যেমন হয়, চিৎকার করলেও আওয়াজ বাইরে শোনা যায় না। ঠিক তেমন। মনে হচ্ছে কেউ একজন তার ঠোট দুটো চেপে ধরে রেখেছে। যেন কান্নার আওয়াজ বাইরে যাওয়া নিষেধ। ঐ যে কথায় আছে, পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। অথচ অনুভূতির কোনো জেন্ডার নেই। পুরুষ কিংবা নারী হোক, কাঁদতে কারুরই নিষেধ থাকা উচিত না।

এক মুহুর্তের জন্য রাজীভের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। রুমের মধ্যে খয়েরি রঙের প্রত্যেকটা জিনিস দেখতে বিরক্ত লাগছিলো। নিজের গামছা, টেবিলের রঙ, লকার আর কত কি। কে বলে বিষাদের রঙ নীল? এই মুহুর্তে রাজিভের কাছে বিষাদের রঙ খয়েরি। নিজেকে সামলে নিয়ে স্থির হয়ে বসল রাজিব। কার্ডটা হাতে রেখে প্রায় আধাঘণ্টা একই ভঙ্গিতে বসে রইলো। এরপর নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করল। আনিতার সাথে তো তার প্রেম হয়নি। শুধু শুধু নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছে। কার্ডটা টেবিলে ফেলে গামছা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ঝরনা ছেড়ে দিলো। মাথার উপর পানি পড়ছে। এখন একটু ভালো লাগা শুরু হলো। মনে মনে নিজেকে বলছে, স্রষ্টা অবশ্যই আমার জন্য আরো ভালো কিছু রেখেছেন।

মানুষের সেল্ফ ডিফেন্স ম্যাকানিজমে স্রষ্টা বেশ কাজে আসে। মানুষ কোনো অন্যায় করলে কোনো দিন না কোনো দিন তার বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন সে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চায়। আবার কিছুর অভাববোধ করলে স্রষ্টার কাছে চায়। না পেলে মনে করে স্রষ্টা আরো ভালো কিছু রেখেছেন। এইটা সেল্ফ ডিফেন্স ম্যাকানিজম। যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকত, তাহলেও মানুষ এমন কিছু সৃষ্টি করে নিত যেখানে সে নিজেকে সপে দিতে পারে। সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীরা এই সুবিধাটা পায়।

হয়তো স্রষ্টা রাজিভের জন্য ভালো কিছু রেখেছে। তবে সে কখনোই আনিতাকে পাবে না। তাকে পাবার যে স্বাদ তা কোনোদিনও নিতে পারবে না। তার চোখে তাকিয়ে থাকার যে অনুভূতি তা কখনো অনুভব করবে না। কারণ মানুষ এক সাগরে দ্বিতীয়বার গোসল করে না।

আনিতার অপূর্ণতা রাজিভের জীবনে থেকে গেল। এটাই তো জীবন। পূর্ণতা এলে তো সেটা স্বর্গ হয়ে যেত। মর্ত্যে থেকে স্বর্গের স্বাদ পেলে স্বর্গে গিয়ে কাজ কি! এজন্মে না হয় মিলন না ই হলো।

গতমাসে লালনের আখড়ায় গিয়েছিলাম। একদল লোক গান করছিলো তখন। দর্শক সাড়ি থেকে এক মেয়ে বলেছিলো, মিলন হবে কত দিনে এই গানটা ধরেন। যে লোকটা গান গাচ্ছিল, সে এটা শুনে জবাব দিয়েছিলো, "মিলনের পরে আর কিছু থাকে না, মা। মিলন হলেই সব শেষ।" রাজিভের জীবনে হয়তো সব শেষ হয়ে যায়নি, একারণে আনিতার সাথে মিলনও হয়নি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আত্মহত্যা

অনিদ্রিতা

প্রাক্তন