গোধূলির প্রেম- ১

বন্ধুর আহবানে কিছুদিন অবকাশ যাপনের জন্য বি. বাড়িয়া এসেছি। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসদী ইউনিয়নের খাউরপুর গ্রাম। ঢুকতেই গ্রামের রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত। তালগাছ, সুপারি গাছের শারি। কিছুদূর যাওয়ার পর ছোট-বড় কাচা-পাকা বাড়ি চোখে পড়লো। গ্রাম ছোট, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট একটি খাল, যেটি বর্ষাকালে বিলের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। একটি বড় খেলার মাঠ, মসজিদ ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে এ গ্রামে। ছোট একটি স্পোর্টিং ক্লাবও রয়েছে। গ্রাম বলতে যা বুঝায় তার সব কিছুই বিদ্যমান।


আমি আপন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করছি এবং সরকারী চাকুরী প্রত্যাশী। শহুরে যান্ত্রিক জীবন থেকে একটু নিস্তার পেতে গ্রামের দিকে ছুটে চলা। আমার জন্ম গ্রামে হলেও থাকা হয়নি বেশিদিন। তাই সুযোগ হলেই ছুটি গ্রামের পানে। গ্রামের রাস্তার ধারে তীব্র বাতাসে সবুজের গন্ধে নিজেকে সঁপে দেই। হারিয়ে যাই আমি, এ যেনো স্বর্গেরই অন্যরূপ।

যাইহোক, এখানে আসার আরো একটি কারণ আছে। এ গ্রামে বাড়ি বাড়ি ধান উঠে যাওয়ার পর একটি উৎসব পালিত হয়, ঠিক নবান্ন উৎসবের মত। এখানে গ্রামের মানুষের বাইরে কেউ থাকে না সচরাচর। সন্ধ্যায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। এখন দুপুর, আপাতত খাবার খেয়ে বিশ্রাম করব। ভালো কথা, আমি আমার বন্ধুকেই পরিচয় করিয়ে দেইনি। মাসুম, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমরা। একই আবাসিক হলে থাকতাম। গ্রাজুয়েশনের পর মাসুম নিজ গ্রামে মাছের ঘেড় ও পল্ট্রি ফার্ম দিয়েছে, চাকুরীর প্রতি ওর যেন এলার্জি ছিলো।

বিকেলে হাটতে বেড় হলাম, বন্ধুর বাড়ি থেকে ৭-৮ মিনিটের দূরত্ব চায়ের দোকানের, সেখানে গিয়ে বসলাম। তিন রাস্তা এখানে মিলিত হয়েছে। একটি রাস্তা বিলের পাড় ধরে অন্য গ্রামে, আরেকটি পৌরসভার দিকে। দোকানের পেছনে বয়ে যাওয়া খাল, একপাশে দিগন্তব্যাপী ধানক্ষেত। এ সময় সিনিয়র সিটিজেন অর্থাৎ মুরুব্বীদের থাকার কথা দোকানে, কিন্তু আজকে উৎসব আছে। তরুনদের সাথে তারাও ব্যস্ত। চা দোকানী হাসান ভাইকে দুটো দুধ চা দিতে বললাম। চিন কম, দুধ বেশি। দোকানে বসেই সিগারেট জ্বালালাম। গ্রামের বাতাস মানে ফ্রেশ এয়ারে সিগারেট খাওয়ার অনুভূতি অন্যরকম। শহরের বাতাস তো সিগারেটের ধোয়ার চেয়েও দূষিত। চোখ বুজে একটা লম্বা টান দিলাম বেনসন লাইটে, অসাধারণ। সিগারেটের ধোয়া টেনে আর দুধ চায়ে চুমুক দিয়ে বলতে লাগলাম, "নাদের আলী, আমি আর কত বড় হব?"

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, অনুষ্ঠান হবে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। বাড়ির ভিটায় বানানো হয়েছে মঞ্চ। ভেতরে প্রবেশ করলাম, ছোটখাটো যাত্রার আয়োজনের মত। ৬০-৭০ জন মানুষ হবে। ছোটোবড়ো সব বয়সের মানুষের উপস্থিতি রয়েছে। পাশে একটি ঝালমুড়ি ও চানামুঠের (চানাচুর ও পেয়াজের মিশ্রণ) এর দোকান বসেছে। মাসুম আমাকে মোটামুটি ছোটোবড়ো সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, যার একজনকে নিয়েই গল্প লেখা। বিথি, বয়স আনুমানিক ২৩। শ্যাম বর্ণ, উচ্চতা ৫.৪ কি ৫.৫। চোখ দুটো গোলাকার, নাক বোচা, ঘনকালো চুল তবে পিঠ ছুই ছুই। বাম চোখের কিছুটা উপরে একটা তিল, যা তার সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। কালো রং এর ফ্রক পড়েছে। মাসুম যখন তার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো তখন সে তার হাত বাড়িয়ে

-বিথী, মাইশা আক্তার বিথী
-বাব্বাহ, জেমস বন্ড স্টাইল?
- জেনস বন, সে আবার কে?
-কেউ না, পার্টটাইম খেলোয়াড়
-ওহ

বিথীর ব্যাপারে একটি তথ্য জানিয়ে রাখি, দশ গ্রামের ছেলেদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে সে ওস্তাদ। আমাকেও হয়তো সেই দশ গ্রামের ছেলেদের একজন বানাতে চেয়েছিলো। আমি বললাম,

-আপন
-তা আপন ভাইয়ের চুল কি তার সাথে রাগ করছে নাকি? মাথা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

এরকম অবস্থার জন্যই মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি, নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

-কিছু জিনিস তো আমরা চাইলেও ধরে রাখতে পারি না, যেমন আপনার মুখ (জবান)।

বিথীও একটু অপ্রস্তুত হলো, আর তার অভিব্যক্তি এমন ছিলো যে দেখে নিবে আমায়।

ইতোমধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে, এরপর মাসুম মাইকে যা ঘোষণা করলো তা শুনে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমাকে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে হবে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, একবার তো আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো ওর। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অনেকগুলো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছিলাম। মাইক হাতে নিয়ে বললাম

-ধন্যবাদ মাসুমকে আমাকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আপনাদের এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে পারা আমার জন্য সম্মানের। এ গ্রাম অনেক সুন্দর, (বিথীর দিকে তাকিয়ে) গ্রামের সবকিছু ভালো লেগেছে আমার (বিথী মুখ বাকা করলো)। প্রথমেই খালেক চাচার একক অভিনয়, অভিনয় নিয়ে আসছে খালেক চাচা।

সবাই হাতে তালি দিলো। এরপর আরেকজন আসলো নাচ নিয়ে, ৫-৬ মিনিটির বিরতি পাওয়া গেলো। সিগারেট খেতে মঞ্চ থেকে একটু দূরে পুকুর পাড়ে আসলাম। সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। অন্ধকারে দূর থেকে কেমন কয়েকটা অবয়ব আসছে আমার দিকে। মাঝে মাঝে আমি ভয় পেয়ে যাই, বুক গড়ম হয়ে গেলো। যখন একবারে সামনে আসলো তখন বুঝলাম এটা কেমন ভূতপ্রেত। বীথি, তার সাথে দুই চেলা। আমার সামনে এসে একটি মুচকি হাসি দিয়ে,

- তা ঢাকায়া ভাই দেখি সিগারেটও খান।
- কেন, কোনো সমস্যা আছে নাকি? ধূমপান নিষেধ নাকি এই গ্রামে?
- নিষেধ না, খেতে পারবেন। তবে ভাগ করে খেতে হবে। একা একা খাওয়া নিষেধ।
- এই সময় সিগারেট ভাগ করার লোক কই পাব?
- কেন আমারে পছন্দ হয় না?
- আপনি সিগারেট খান?
- কেন? কি এমন অযোগ্যতা দেখলেন আমার মধ্যে যে এভাবে জিজ্ঞেস করলেন?
- সিগারেট খেতে বিশেষ কোনো যোগ্যতা লাগে না, টাকা লাগে। আর এ গ্রামের কোনো মেয়ে সিগারেট খেতে পারে তা বুঝতে পারিনি।
- তা এখন কি শুধু বুঝতেই থাকবেন নাকি দিবেন?
- কি দিব?
- সিগারেট...!!

অনিচ্ছা সত্বেও বিথীকে সিগারেট দিতে হলো। গ্রামের কেউ যদি জানতে পারে তাদের গ্রামের মেয়েকে সিগারেট দিয়েছি আমি, তাহলে জুতোপেটা করে গ্রাম থেকে বেড় করবে আমায়। গ্রামের মানুষ যতদ্রুত আপন করে নিতে জানে, তত দ্রুতই দূরে ঠেলে দিতে পারে।

সিগারেটে কয়েক টান দিয়ে সিগারেট আমার হাতে দিতে এসে বিথী এমন একটা কাজ করলো যা দেখে আমি তৃতীয় বারের মত অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এরকম অবস্থা সৃষ্টি হবে বুঝতে পারিনি। নইলে দূরত্ব বজায় রেখে দাড়াতাম।

[বি. দ্র. ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর]

To Be Continued


সময়ঃ ০৯.২১ এএম
রবিবার, ১২ জুলাই, ২০২০ইং

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আত্মহত্যা

অনিদ্রিতা

প্রাক্তন