জারজ

তুই তো একটা জারজ সন্তান” এ কথা শুনতেই রকির নাক বরাবর কষে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো মানিক। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড় হতে লাগলো রকির নাক দিয়ে। মাঠে সবাই ভয় পেয়ে গেলো। সাহিদ বললো,

-কি করেছিস মানিক? এতো রক্ত বের হয়ে গেলো
-বেশ করেছি , শালা আমাকে বলে ”জারজ”।
খেলার মাঠে একটা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রকি আর মানিকের মধ্যে ঝগড়া বাধে। মানিক বল করে, ব্যাটে থাকা সাহিদ আউট হয়। কিন্তু আম্পায়ার হিসেবে দাড়ানো রকি বলে নো বল। ব্যাস অমনিই মানিকের মাথা গড়ম হয়ে যায়। তর্কের এক পর্যায় যখন রকি মানিককে “জারজ” বলে গালি দেয়, অমনি ঘুষি বসিয়ে দেয় মানিক।
এতক্ষণে রকির বাড়ি খবর পৌছে গেছে। রকির দাদা চেয়ারম্যান। গত নয় বছর ধরে সে এ দায়িত্ব পালন করে আসছে। সে যখন শুনেছে তার নাতি খেলার মাঠে মার খেয়েছে, তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসছে। দেখবে কার এত বড় কলিজা যে চেয়ারম্যানের নাতির গায়ে হাত তুলেছে। চেয়ারম্যান হামিদ সিকদার স্কুলে এসেই গেল হেডমাস্টারের রুমে। তাকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌছেই হাক ছাড়লো যে, কার এত বড় সাহস যে সে তার নাতিকে মেরেছে। মানিক সামনে এসে বলল যে সে মেরেছে। মানিককে দেখতেই চেয়ারম্যানের মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। হেড মাস্টারকে বিচার করতে বলে সে চলে গেল।
তিন গ্রাম পরেই মানিকের বাড়ি। সন্ধায় মানিকের মা কে চেয়ারম্যান ডেকেছে। তড়িঘড়ি করেই মানিকের মা রাহেলা বেগম চেয়ারম্যানের বাড়ি আসল। চেয়ারম্যান উঠোনে বসে তামাক টানছিলো। মানিকরে মাকে দেখতেই তার মুখখানা অর্ধচন্দ্রের মত হয়ে গেল।
-কেমন আছেন চাছা?
-হু ভালো
-আমারে ডাকছেন কেন?
-তোরে না কইছি তোর পোলারে লইয়া এই জেলা ছাইড়া চইলা যাবি? যাস নাই কেন? আবার তারে আমার এলাকার স্কুলে ভর্তি করাইছস?
-নিজের বাড়ি ছাইড়া কই যামু চাছা?
-তর বাড়ির নিকোছি করি আমি। তোর পোলার সাহস হয় কি কইরা আমার নাতির গায়ে হাত দিতে? হিগাইয়া দিছস সব?
-মারামারি করতে হিগামু কেন? অয় একটু এমনই। কারো গালি সইহ্য করতে পারে না। আর আপনেগোই ত রক্ত, একটু মাথা গরম।
-চুপ কর হারামজাদী, এই ল ৫০ হাজার টাহা, কাইলই এ জেলা ছাইড়া অন্য জেলায় যাবি। আর কোনো দিন এ এলাকায় পা ফালাবি না।
৫০ হাজার টাকার একটা বান্ডেল রাহেলার সামনে ছুড়ে হামিদ সিকদার ঘরের ভেতরে চলে গেলো। রাহেলা চেয়ারম্যানের পানে তাকিয়ে রইল।

রাহেলা বেগম ছিলো কৃষক পরিবারে মেয়ে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এরপর আর পড়তে পারেনি। বাড়ির কাজ করেই তার দিন কাটতো কৈশোরে। তাদের দুই ইউনিয়ন পরেই ছিলো চেয়ারম্যানের বাড়ি। চেয়ারম্যানের এক পুত্র হেমায়েত সিকদার। তখন সে বিশ্ববিদ্যালের ৩য় বর্ষে পড়াশোনা করত। রাহেলাকে হেমায়েতের ছোট বেলা থেকেই ভালো লাগত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সে উঠল রাহেলার তখন উঠতি যৌবন। ছুটি পেলেই সে বাড়ি যেত। এর কারণ ছিলো রাহেলাকে এক নজর দেখা। তাদের প্রেম এক সময়ে প্রণয়ে রূপ নিলো। যদিও তার দুজনেই জানত তাদের এই সর্ম্পক হামিদ সিকদার কোনো দিনও মেনে নেবেন না। তবুও প্রেম মানে না বাধা, মানে না জাতি-কুল।

হাটৎ হেমায়েত গ্রাম থেকে একদিন খবর পায় রাহেলা তিন মাসের অন্তসত্বা। হেমায়েত সাথে সাথে গ্রামের বাড়ি রওনা করে। বাড়ি গিয়েই সে প্রথমে রাহেলার বাড়ি যায়। রাহেলা মা তাকে দেখেই কান্না জুড়ে দিয়ে বলে,
-বাবা, আমার মাইয়ার এত বড় সর্বনাশ কেন করলা?
-দেখেন যা হওয়ার হইছে, আমি আব্বার সাথে কথা কইতাছি।
রাহেলার সাথে দেখা হতেই রাহেলা হেমায়েতকে বলল,
-আমারে বিয়া করবেন না?
-করব, সময় হোক।
হেমায়েত বাড়ি তার বাড়ি এসে তার বাবার কাছে সবকিছু খুলে বলল। হামিদ সিকদার আগুনের মত চোখ রাঙিয়ে হেমায়েত কে বলল
-ঐ মাইয়ারে বিয়া করলে তোরে আমি ত্যাজ্য পুত্র করুম। হেমায়েত তার বাবাকে কিছু না বলেই রাহেলাকে কোর্ট মেরেজ করে ঢাকা চলে আসল। দুই মাস পড়েই হামিদ চেয়ারম্যান তার ছেলেকে বাড়ি এনে অনেকটা জোরর্পর্বক বিয়ে দেয়। হেমায়েত তার বাবার মুখের উপর কিছুই বলতে পারে না। কিছু দিন গ্রামে থেকে সে আবার ঢাকায় চলে যায়।

প্রায় ছয় মাস পর খবর পেল রাহেলা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আদর করে তার সন্তানের নাম রেখেছে মানক। তার সন্তানকে নিয়ে সে চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছে।
এক বছর পরেই সে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। এরপর অনেক বছর কেটে গিয়েছে। সেই মেয়েও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে। নাম রেখেছে রকি। হেমায়েত সিকদার এরপর আর কখনো দেশে আসেনি। সবার কাছে সে নিজেকে গোপন করেছে। হেমায়েত-রাহেলার ভুল, হামিদ চেয়ারম্যানের দাম্ভিকতাই মানিকদের করে রেখেছে ”জারজ”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আত্মহত্যা

অনিদ্রিতা

প্রাক্তন