একজন ইশা ও প্রেমের অপমৃত্যু

গাড়ি থেকে নেমে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সামাজিক বিজ্ঞান চত্বরে বসলো অনিক। সিগারেটে আগুন দিতেই ফিরে গেলো তার অতীতে।


সময়টা ২০০৫ সাল। ফেব্রুয়ারী মাসের ৩ তারিখ, সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে উর্দু বিভাগে ভর্তি হয়েছে। মনটা খারাপ, ইংরেজীতে কম নম্বর পাওয়ায় এখন উর্দু পড়তে হচ্ছে। মন এজন্য খারপ না যে সে উর্দু পড়ছে, মন খারপ তার তার কলেজের বান্ধবী ইশার জন্য। ইশা ইংরেজী বিভাগে একই বর্ষে পড়শোনা করছে। কলেজে থাকতে তাদের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠে। কলেজে দুইজন আলাদা সেকশনে থাকলেও তারা দুজনেই মানবিকের শিক্ষার্থী ছিলো। নিজ সেকশনে তারা দুজন প্রথম ছিলো। তবে সম্মিলিতভাবে ইশা ছিলো প্রথম। ভেতরে ভেতরে একটা স্নায়ুযুদ্ধ চললেও উপরি উপরি তাদের বেশ ভাব ছিলো। যখন এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল বের হলো তখন অনিক পেল ৪.৫০ অন্যদিকে ইশা পেল জিপিএ ৫.০০। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো ভর্তিযুদ্ধ। এখন ইশা ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী অন্যদিকে অনিক উর্দুতে।


বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু সবাই নতুন বন্ধু তাই ইশাকে খুব কাছের মনে হতে লাগলো অনিকের। প্রাই তাদের নিয়মিত দেখা হত কলা ভবনের গেইটে। অনিক কথা বলতে চাইত কিন্তু ইশা তার ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যেত। অনিক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত ইশার পানে। ইশা দেখতে একটু খাট হলেও তার কথায় তেজ ছিলো। এযেন এক সম্মোহনী কন্ঠ, শুনলেই শুনতে মন চাইত। ইশা যদি অনিককে তার নাম ধরে ডাক দিত, অনিকের ভেতরে আলোকবর্ষ গতিতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হত। এযেন স্বর্গীয় অনুভুতি।


জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের তিন তারিখ, বৃহস্পতিবার, আজ তিনটায় ইশার ক্লাস শেষ হবে। নিজের ক্লাস রুটিন মনে না থাকলেও ইশার ক্লাস রুটিন ঠিকই মনে থাকত অনিকের। শাহবাগ থেকে ৪টাকা দিয়ে একটি লাল গোলাপ কিনে এনেছে অনিক। আজ সে ইশাকে তার অনুভূতির কথা জানাবে। জানাবে প্রতি রাতে হলের ছাদে বসে আকাশে দিকে তাকিয়ে ইশাকে নিয়ে তার দেখা কল্পনাজগতের প্রতিটি মুহূর্ত। ৩.০৭, ইশা ক্লাস থেকে বের হয়ে কলা ভবনের গেইটে আসতেই অনিক ইশাকে বললো , তার সাথে কথা আছে। ৫ মিনিট সময় দিতে পারবে কিনা। ইশা হ্যা সূচক জবাব দিতেই বললো চলো লাইব্রেরীর সামনে যাই। দুজনেই হাটছে লাইব্রেরীর দিকে। অনিকের হার্টবিট অস্বাভাবিক আকারে বেড়ে চলেছে।


-ইশা আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি
-হ্যা, তো?
-এটা তোমার জন্য
-সরি???
-আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি ইশা
-অনিক, আর ইউ ম্যাড? উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড
-কিন্তু ইশা.
-দেখো, তুমি উর্দুতে পড়ো, তোমার ফিউচার কি তা তুমি নিজেই জানো না। তোমার সাথে জড়িয়ে আমি আমার জীবনে কেন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলব??
-কিন্তু
-প্লিজ অনিক, এসব পাগলামি ছাড়ো, তোমার যোগ্য কাউকে খুজে তার সাথে গিয়ে প্রেম করো। ডিজ্গাস্টিং..
-ইশা
-আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি ইউ এগেইন


ইশা চলে গেলো, অনিক ঢ্যাপ ঢ্যাপ করে তাকিয়ে রইলো ইশার দিকে। নিজেকে তার রাস্তার আবর্জনার মত লাগলো। ফুলটা ফেলে দিয়ে একটা গোল্ডলিফ সিগারেট কিনল, সে গোল্ডলিফ সিগারেট খায় না, গোল্ডলিফ সিগারেট খেলে তার প্রচন্ড মাথা ঘুড়ায়, একবার তো হলের দোকনের সামনে বমিই করে ফেলেছে। কিন্তু এখন আর তার মাথা ঘুড়ছে না। যাকে নিয়ে সে এতো স্বপ্ন দেখেছিলো সে তার স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথে রীতিমত অপমান করে গেলো।


২০১৯ সাল , কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে জায়গাটায় দাড়িয়ে সে ইশাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো, সেখানে এখন ইট দিয়ে মানুষের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক ঐখানটায় বসে আছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মেয়েটার হাতে একটা লাল গোলাপ। মনে হচ্ছে সদ্য ফুটেছে। হাটাৎ অনিকের মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা এলো। আচ্ছা তখন যদি এরকম বসার জায়গা থাকত, তাহলে কি সে আর ইশা এভবেই বসে থাকত? আর যদি বসেই থাকত তাহলে কি অন্য কোনো অনিক তাদের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকত???
হয়তো বা থাকতো, আর থাকলে সেও কি অনিকের মত পুলিশের এস পি থাকত? হয়তো বা থাকত, হয়তো বা না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আত্মহত্যা

অনিদ্রিতা

প্রাক্তন