মতিভ্রম

সারা বিশ্ব মাতিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। এর প্রভাবে ২০২০ সালের মার্চেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ফলে আবাসিক হলগুলোও বন্ধ হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারে কাছে ছুটে যায়, আমার বেলায়ও ঠিক এমনটাই। তবে আমাকে গ্রামের বাড়ি যেতে হয়নি। বাবা-মা ঢাকায় থাকার দরুন লকডাউনের শুরু থেকেই ঢাকায় ছিলাম। মাঝে এক-দুবার হলে গিয়েছিলাম প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ কিছু জামাকাপড় আনতে।


কিছুদিন আগে হলের বন্ধু হুমায়ূন কল করে, ওর কিছু বইপত্র ছিলো আমার কাছে, সেগুলো লাগবে। বইগুলো হলে রেখেই চলে এসেছিলাম। আবার হলে যেতে হবে সেগুলো আনতে। তাই আজকে দুপুর দিকটায় বাসা থেকে বের হই হলে যাওয়ার জন্য।

হল গেটে এসে মামাদের কাছে হলকার্ড সহ আবেদনপত্র জমা দিয়ে হলে প্রবেশ করি। আমার রুমটা হলের মাঝখানের ব্লকে, ৩৪১ নম্বর রুম। হলের মাঝের ব্লকে থাকায় যেমন বাতাস বয়ে যেত আমার রুম দিয়ে ঠিক তেমনি ধুলোবালিও বয়ে যায়। রুমের তালা খুলতেই ধুলোঝাড়া বাতাস মুখে এসে লাগলো। ভেতরে ঢুকে বইপত্র গুছাতে লাগলাম । বই গুছাতে গুছাতে ভাবতে লাগলাম, কত স্মৃতি আছে এই রুমটায়। রাজনীতি, সুজনের পাগলামী, মেহেদীর থার্ড আই আর ভিডিও চ্যাটে কান্নার অভিনয় আরো কত কত কাহিনী।

বই গুছানো হয়ে গেছে, বের হয়ে তালা দিব এই সময় হলের ফ্লোরে মাসুম ভাইয়ের সাথে দেখা। মাসুম ভাই, ২০১৫/১৬ সেশনের ছাত্র। আমাদের হলের, আমার রুমের ঠিক তিন রুম পরে থাকতেন। সরলতার যে কোনো সীমা নেই তা মাসুম ভাইকে দেখলে বুঝা যায়। রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও অনেককিছু জানতেন। মাঝে মাঝে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিতাম। হতাশ থাকলেই ভাইয়ের কাছে চলে যেতাম। ভাই এক অদ্ভুত চা বানাতে পারতেন, চায়ের ম্যাটেরিয়ালস যে তিনি কোথা থেকে আনতেন তা কেউ জানত না। জিজ্ঞেস করলে হাসতেন, তবে অসাধারণ স্বাদ ছিলো সে চায়ের।

ভাইকে দেখার সাথে সাথেই জড়িয়ে ধরলাম হাতের ময়লা সহ।

-কি লিডার (ঠাট্টা করে আমাকে ডাকতেন) কি খবর?
-ভাই, কেমন আছেন?
-ভালো রে, তোর কি অবস্থা?
-ভালো ভাই, কবে আসছেন?
-এই তো মাত্রই, হল থেকে কম্বোলটা নিব, যেই ঠান্ডা।
-কি বলেন ভাই, ঠান্ডা তো আস্তে আস্তে কমেই গেছে, শার্ট পরেই বের হয়ে গেছি।
-তোমরা নেতা মানুষ, রক্ত গড়ম। আমার তো রক্তই চলে না।
-
কথার আগামাথা কিছু বুঝলাম না,

-ভাই ঢাকায় আছেন, নাকি বাড়ি চলে যাবেন?
-নারে, কম্বল নিয়ে বাড়ি চলে যাব।
-ওহ, চলেন তাইলে একসাথে বের হই, এফবিএস এর সামনে চা খাই।
-তুই বের হ, আমি কাজ সেরে রুম তালা দিয়ে আসি।
-ঠিকাছে ভাই


হল গেটে এসে গেস্ট রুমে বসে আছি মাসুম ভাইয়ের অপেক্ষায়। ফেইসবুকে নোটিফিকেশন আসলো মেমোরিজের, ওপেন করলাম। দুইবছর আগের একটি পোস্ট,

"আপনার মত মানুষ এরকম কাজ করবে কখনো কল্পনা করতে পারিনি। ওপারে ভালো থাকবেন, আপনার বানানো চা হয়তো আর কোনো দিন খাওয়া হবে না। রেসিপিটা যে বলে যাননি ভাই।

-আপনার লিডার"


কিছুক্ষণ পোস্টের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কি ঘটলো আমার সাথে? মতিভ্রম? সৃষ্টিকর্তা জানেন ভালো জানেন।

বছর দুয়েক আগে মাসুম ভাইয়ের হল রুমে ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকা লাশ আবিষ্কার করে তার রুমমেট। আত্মহত্যা করেছেন মাসুম ভাই, আশার কথা শোনানো মাসুম ভাই আত্মাহুতি দিয়েছেন। কারণ যানা যায়নি, তবে বিনা কারণে আত্মহত্যা মাসুম ভাই করতে পারেন না একথা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানলে তা সৃষ্টিকর্তাই জানবেন।

(কাল্পনিক)

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আত্মহত্যা

অনিদ্রিতা

প্রাক্তন